গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ। The cause of the increase of sin.

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ


*কু-দৃষ্টি গোনাহের প্রথম সিঁড়ি*⬇️


✔️ঈমানদার মুসলমানকে আক্রান্ত করতে শয়তানের প্রথম তীর হচ্ছে কু-দৃষ্টি” দৃষ্টিই প্রথমত গোনাহের কথা চিন্তা করায়। অতঃপর মন স্থির সংকল্প করে। ফলে গোনাহ সংঘটিত হয়ে যায়। দৃষ্টি যদি এমন কিছু না দেখতো যা গোনাহের ইচ্ছা জাগায়, তাহলে সেই গোনাহও সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আল্লাহ্ রাব্বুল আ'লামীন কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন ‘হে নবী, আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে নামিয়ে রাখে, এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই হবে তাদের জন্য সর্বোত্তম পবিত্রতা। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা'আলা তাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগতো। 

*[সূরা নূর: ৩০]*

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

✔️সুতরাং দৃষ্টির হেফাজতের মাঝেই লজ্জাস্থানের হেফাজত। দৃষ্টিকে আল্লাহর ভয়ে ভীত রাখতে পারলে মুমিন অন্যান্য গোনাহ থেকেও নিরাপদ থাকতে পারবে। অন্যথায় মনের শতো দৃঢ়তা সত্ত্বেও গোনাহ সংঘটিত হয়েই যাবে। তাই দৃষ্টিই হচ্ছে মুমিনের মনে শয়তানের প্রবেশ পথ। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা মুমিন নারীদের প্রতি হিদায়াত দান করে বলেছেন, “হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে নামিয়ে রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তাঁরা যেনো সাধারণতো যা প্রকাশমান, তা ব্যতিত তাদের সৌন্দর্যের প্রকাশ-প্রদর্শন না করে।” 

*[সূরা নূর: ৩১]*⏬

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

✔️এই দুই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা'আলা মুমিন-মুমিনাদের প্রতি গোনাহের এক মূলনীতি পেশ করেছেন। অর্থাৎ গোনাহের জন্যে প্রথম সিঁড়ি হচ্ছে দৃষ্টি।” কেউ যদি গোনাহ থেকে বাঁচতে চায়, আর দৃষ্টিকে সংযতো না রাখে, তাহলে সে কখনই সফলকাম হবে না।⏬


📗কুরআন কারীমের পাশাপাশি হাদীসে নববীতেও দৃষ্টিকে যথাযথো হেফাজতের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। হযরত বুরাইদা থেকে বর্ণিত আছে, নবীজী *(সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম)* হযরত আলী (রাযি:) কে লক্ষ্য করে বলেছেন, হে আলী! অনিচ্ছাকৃত দ্বিতীয়বার চোখ ফিরিয়ো না। কেননা প্রথমটি তোমার জন্য বৈধ, দ্বিতীয়টি বৈধ নয়। *[মিশকাত শরীফ]*

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

📚রাসূলুল্লাহ্ *(সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম)* এর যুগে কিছু সাহাবী রাস্তায় বসতো। তাদেরকে বলা হলো, তোমরা রাস্তায় বসো না। সাহাবীরা আরয করলো, রাস্তায় (ব্যবসায়িক কাজের উদ্দেশ্যে) বসা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। নবীজী *(সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম)* বলে দিলেন, তাহলে তোমরা রাস্তার হক আদায় করবে। সাহাবীরা জানতে চাইলো রাস্তার হক কী? নবীজী *(সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম)* বললেন, রাস্তার হক হচ্ছে-দৃষ্টি নীচু রাখা, রাস্তার উপর থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে ফেলা, সালামের জওয়াব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের প্রতি বাধা প্রদান করা। *[মিশকাত শরীফ]*


✅দৃষ্টির হেফাজতের মধ্যেই চোখের মাধ্যমে সংঘটিত গোনাহের মুক্তি। মূলতো দৃষ্টিকে হেফাজতের মধ্যেই অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয়ভীতির সৃষ্টি হয়। এর উদাহরণ হচ্ছে, কুরআন কারীমের সূরা নূরের ঐ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, “মুমিনরা সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের নামাজে ভীত ও নম্র থাকে এবং যারা অনর্থক কথা-বার্তা থেকে নিবৃত্ত রয়েছে, তারা যাকাত আদায় করে থাকে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের উত্তম হেফাজত করে।”⏬

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

📗এই আয়াতের শানে নুযূল বর্ণিত হয়েছে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মুমিনদের জন্যে নামাজের ভেতর কথা-বার্তা, সালাম-কালাম করার অনুমতি ছিলো। নামাজের ভেতর অন্যদিকে তাকানোও বৈধ ছিলো। পরবর্তীতে নামাজী ব্যক্তির মনে আল্লাহ্ তা'আলার আযমত ও খাশিয়াত তথা ভয়-ভক্তি বাড়ানোর জন্যই নামাজের ভেতর সবধরনের কথাবার্তা নিষিদ্ধ হয়। এক সাহাবী যার এ নতুন বিধান সম্পর্কে পূর্ব অবগতি ছিলো না, তিনি এসে নবীজিকে সালাম দিলেন। নবীজি নামাজে মশগুল ছিলেন। সালামের উত্তর দিলেন না। সাহাবী কাতারে দাঁড়ানো সাহাবীদের উদ্দেশ্যে সালাম দিলেন, কিন্তু কোনো সাহাবীও উত্তর দিলেন না। আগন্তুক সাহাবী পেরেশান হলেন। সাহাবীরা তাঁর পেরেশানী লক্ষ্য করে তাকে পায়ের উপর শব্দ করে থামতে বললো। নামাজ শেষে নবীজী *(সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম)* সাহাবীকে নতুন হুকুম জানিয়ে দিলেন। নামাজে এদিক সেদিক তাকানো থেকে বিরতো করার উদ্দেশ্য ছিলো অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি সৃষ্টি করা। নামাজের বাইরেও কেউ যদি মনে আল্লাহর ভয় ও যিকির স্মরণ রেখে চলা-ফেরা করে তাহলে তাঁর দ্বারা গোনাহের সম্ভাবনা শতোভাগ বিলুপ্ত হবে।⏬

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

✅দৃষ্টির হেফাজতের তাৎপর্য হচ্ছে, এমন কোনো জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা, যা দ্বারা অন্তরে গোনাহের কথা চিন্তা হয়। চাই সে জিনিস দেখা বৈধ হোক বা অবৈধ। কখনো বৈধ জিনিসের দিকে অযথা দৃষ্টিপাতের কারণেও মনে গোনাহের কথা কল্পনা হতে পারে, তাই গোনাহ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তা থেকে বিরতো থাকাই উত্তম। বুযুর্গানে দ্বীনের এমন বহু ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে, তাদের জীবনীতে বর্ণিত হয়েছে- তারা নিষিদ্ধ বস্তু তো বটেই, এমন বৈধ জিনিস দেখা থেকেও বিরতো থাকতেন যা অন্তরে গোনাহের ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে। নীচে এমন কিছু ঘটনাই সংকলন করে দেখানো হলো। হয়তো এর দ্বারা কারো অন্তঃচক্ষু খুলে যাবে এবং গোনাহের একটি উন্মুক্ত পথ রুদ্ধ হবে।⏬


*১)* দাউদ বিন আব্দুল্লাহকে একবার বসরার গভর্নর ডেকে পাঠালে তিনি তাঁর বাসস্থান থেকে রওনা হয়ে বসরার নিকটবর্তী পূর্বপরিচিতো এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রিত হলেন। বন্ধু তাঁর খেদমতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাজার সদাই করার জন্যে সে বাইরে যেতে ইচ্ছে করলো, তখন সে তার স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, এ হচ্ছে যারকা; আমার স্ত্রী। অত্র এলাকার সেরা সুন্দরী। সে পাশের ঘরেই আছে। কোনো প্রয়োজন হলে নিঃসঙ্কোচে আওয়াজ দিবেন। স্ত্রীকেও ভালোমতো বলে গেলো, আমার বন্ধু অনেক বড়ো বুযুর্গ ব্যক্তি। তার খেদমতে ত্রুটি হয় না যেনো। অতঃপর বাড়ির কর্তা প্রয়োজন সেরে এসে দাউদ বিন আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলো, “যারকা আপনার ঠিকঠাক খেদমত করেছে তো? কেমন লাগলো তাকে?” তিনি বললেন, “কে যারকা?” কর্তা বললো, “আমার স্ত্রী; ঘর থেকে বের হওয়ার আগে যার সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।” নির্লিপ্তভাবে দাউদ বলেন, “তাই বলো। তা আমি কীকরে চিনবো কে যারকা আর কে উম্মে কুহলা? আমি তো এখানে কোনো মেয়ে লোকের অস্তিত্ব টের পাইনি।” এ কথায় কর্তা মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললো, আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম, ‘হযরতের খেদমতে যেনো ত্রুটি না হয়।’ স্ত্রী বললো, “তুমি তো আমাকে অন্ধ ও বধির লোকের খেদমতে রেখে গিয়েছিলে। আমি কতোবার উনাকে ডেকেছি। না তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন, না আমার ডাক শুনেছেন!”⏬

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

*২)* আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি:) বলেন, কোনো এক দলের মধ্যে এক আল্লাহভীরু বুযুর্গ লোক ছিলো। দলের মধ্যে মহিলাদের যাতায়াত ছিলো। কিন্তু বুযুর্গ লোকটি কারো দিকেই তাকাতো না। একদিন তাঁর এই খেয়াল মনে জাগলো যে, দলের অন্য লোকেরা মহিলাদের প্রতি তার ঔদাসীন্য টের পেয়ে গেছে। তাই তাঁর মনে এই ভয়ও উদয় হয় যে, দলের লোকেরা তাকে ভর্ৎসনা করবে এবং সে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষায় পতিত হবে। তখন তাঁর নফস তাকে একটা বুদ্ধি দিলো। সে ওইসব মহিলার দিকে তাকানো শুরু করলো। আসলে এটা ছিলো নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকা। নেক কাজে শয়তানের ধোঁকা আসবেই। তখন উচিৎ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি শয়তান থেকে পানাহ চাওয়া এবং নেক কাজে ইস্তেকামাতের জন্যে সাহায্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ্ তা'আলা সূরা বাকারার ৪৫ নং আয়াতে বলেন, ‘তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।’⏬

পাপ কিভাবে বাড়ে

*৩)* ঝড়ের রাতে এক কুমারী মেয়েলোক এসে মসজিদে আশ্রিত হলো। ওই মসজিদে ইলমে দ্বীন চর্চা করতো এক তালিবে ইলম। মেয়েটি তাঁর অদূরেই বসা ছিলো। স্বল্প আলোতে কেবল সে ইলমে দ্বীনের চর্চায় মশগুল ছিলো। মেয়েটি হঠাৎ দেখতে পেলো, ছেলেটি তাঁর হাতের আঙুল আগুনে পোড়ানোর উপক্রম করছে। আগুনের ভেতর আঙুল দিয়ে আবার সরিয়ে নিচ্ছে। মেয়েটি ভয় পেয়ে বললো, আপনি এমন করবেন না। নিজের নফসকে এভাবে কষ্ট দেওয়া অন্যায়। তালিবে ইলম বললো, যখন থেকে তুমি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছো, আমার নফস আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। তোমার অসহায়ত্বের ফায়দা নিতে প্রলুব্ধ করছে। তাই আমি তাকে দুনিয়ার আগুনের মাধ্যমে জাহান্নামের আগুনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।⏬


*৪)* আবুল হাসান বিন আহমদ (রহ:) কখনো মাথায় রুমাল দেওয়া ছাড়া পথে বেরুতেন না। মাথার উপর দিয়ে রুমালের কিনারা চোখের উপর নামিয়ে রাখতেন। যাতে চলার সময় কোনো দিকে চোখ পড়ে না যায়। একবার তাঁর বোনের বাড়িতে দেখতে পেলেন মহিলাদের কোনো পরিধেয় বস্ত্র। যেটা সামনেই ঝুলানো ছিলো। তিনি বললেন, এটা এখান থেকে সরিয়ে এমন জায়গায় রাখো যাতে পুনরায় আমার চোখে না পড়ে।⏬

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

📖এই সব ঘটনা থেকে বুযুর্গানে দ্বীনের দৃষ্টির হেফাজতে নফসের বিরুদ্ধে মনের অবিচলতার কথা জানা যায়।


☝আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে ও আপনাকেও বুযুর্গানে দ্বীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সর্বদা ঈমানের হালতে চলার তাওফীক দান করুন।  আমীন..!🔚

গোনাহ বৃদ্ধির কারণসমূহ

Post a Comment

0 Comments