মাযহাব কি,কিভাবে সৃষ্টি হল?What Is Mazjab And How Was Created?

 মাযহাব কি ও কিভাবে সৃষ্টি হল

মাযহাব কি,Mazjab


📚সহজ ভাষায় মাযহাব ও তাক্বলীদ ও লা-মাযহাবিয়্যাতের পরিচয়📗⬇


মাযহাব” শব্দটি একটি স্বীকৃত শব্দ ছিলো। ছিলো না কোনো দাগ উক্ত শব্দে। কিন্তু ইদানিং উক্ত শব্দে নানাভিদ কালিমা লেপনের চেষ্টা করছে। ”মাযহাব” বিষয়ে উদ্ভট সব প্রশ্ন তোলে স্বতসিদ্ধ একটি বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।

এ অপচেষ্টার মূল কারণ দু’টি। যথা- অজ্ঞতা কিংবা ফিতনা। 

মাযহাব বিষয়ে সমালোচনাকারীরা হয়তো মাযহাব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণাই রাখেন না। কিংবা জেনেশুনে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার জন্য এ বিষয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

আমাদের অনেকের কাছেই মাযহাব বিষয়টি অস্পষ্ট। আমরা সরল ব্যাখ্যায় উক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা পেতে হলে আমাদের পূর্ণ আলোচনাটি ধৈর্য সহকারে, গভীর মনযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। ইনশাআল্লাহ পূর্ণ আলোচনাটি পাঠের পর আশা করি এ বিষয়টি দীবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে যাবে।⏬


মাযহাব কী?


মাযহাব শব্দের অর্থ হলো, পথ। যার গন্তব্য হলো কুরআন ও সুন্নাহ। আরেক শব্দে বললে, মাযহাব হলো, , যার গন্তব্যের নাম হলো, কুরআন ও সুন্নাহ।


আমরা সবাই কুরআন ও সুন্নাহ অনুপাতে আমল করতে চাই। অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত অজুর ফরজ, হাদীসে বর্ণিত অযুর সুন্নত, মুস্তাহাব, অযু ভঙ্গের কারণ, কুরআনও হাদীসে বর্ণিত নামাযের আরকান, ফারায়েজ, নামাযের মাসনূনাত, কতোগুলি ওয়াজিব, নামায ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট কারণ কতোগুলো? আমাদের দৈনন্দীন জীবনের জীবনঘনিষ্ট মাসায়েলের শরয়ী সমাধান কি? এসব বিষয় আমরা কুরআন ও হাদীসের রীতি অনুপাতে আমল করে আল্লাহকে খুশি করতে চাই।⏬


❇কিন্তু আমরা গায়রে মুজতাহিদ হবার কারণে, কুরআন খুলে স্পষ্ট শব্দে অজুর ফরজ দেখতে পাই না। হাদীস খুলে নাম্বারসহ গোসলের ফরজ, নামাযের বিবিধ মাসায়েল নাম্বারসহ, নির্দিষ্ট আকারে বের করতে পারি না। তখন আমরা মুজতাহিদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বের করা অযুর মাসায়েল, গোসলের মাসায়েল, নামাযের মাসায়েল ইত্যাদি নাম্বারসহ, আলাদা শিরোনাম দিয়ে তারা যা সংকলিত করেছেন, সেই পথনির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা আল্লাহর কুরআন ও তার নবীজী (সাঃ) এর সুন্নাহের অনুসরণ করি।⏬


🔰তাহলে কী দাঁড়াল? 

আমরা মানছি কিন্তু কুরআন ও হাদীস। কিন্তু বুঝি না বলে যিনি বুঝেন, তার বের করা মাসায়েলের অনুসরণ করে মূলত কুরআন ও হাদীসেরই অনুসরণ করছি।

এর নামই মাযহাবের অনুসরণ। মুজতাহিদ ইমামগণ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে মাসায়েলগুলো বের করে আলাদা শিরোনাম দিয়ে, নাম্বার দিয়ে দিয়ে আলাদা করে লিখে যা সংকলিত করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বের করা সেসব মাসআলার সংকলনের নাম হলো মাযহাব। তো মাযহাব অনুসরণ করে আমরা কুরআন ও সুন্নাহই মূলতো অনুসরণ করছি। মূলতো কোনো উম্মতীকে নয়।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিস্কার হতে পারে।⏬


উদাহরণঃ সূর্য যখন ডুবে যায়। পৃথিবীজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। তখন পৃথিবীর বুকে যে বস্তুগুলো আছে তা আমাদের চোখের পাওয়ার দূর্বল হবার কারণে দেখতে পাই না। তখন আমরা হ্যারিকেন, মোমবাতী, লাইট ইত্যাদি জ্বালিয়ে উক্ত বস্তুগুলোকে দেখি। আলোর ফোকাসে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা কিন্তু উক্ত আলোর ফোকাস সৃষ্টি করেনি। বরং আমাদের চোখের পাওয়ারের দুর্বলতার কারণে আগে থেকে থাকা যে বস্তুগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, তা দেখি মাত্র। মোমবাতীর আলোর ফোকাস কোনো কিছু তৈরী করে না, বরং দেখায়।⏬

📗তেমনি কুরআন ও হাদীসের ভিতরে যে মাসায়েলগুলো নাম্বার আকারে, নির্দিষ্ট আকারে লিপিবদ্ধ করা আছে, তা আমরা কুরআন ও হাদীস খুলে নিজেদের ইলমের দুর্বলতার কারণে দেখতে পাই না। যেমন অজুর ফরজ, গোসলের নির্দিষ্ট ফরজ, সুন্নাত, মাকরূহ ইত্যাদি আলাদা আলাদাভাবে নির্দিষ্ট আকারে আমরা দেখতে পাই না। কারণ আমাদের জ্ঞান কম। ইলম কম। অথচ এ মাসআলাগুলো কুরআন ও হাদীসের ভিতরে আছে। তখন আমরা মুজতাহিদ ইমামদের জ্ঞান, তাদের ইলমের প্রদীপের আলোয় কুরআন ও হাদীসের ভিতরের মাসআলাগুলোকে দেখি।

যে মাসায়েলগুলো মুজতাহিদ ইমামগণ তাদের ইলম ও ফাক্বাহাতের ফোকাস দিয়ে কুরআন ও হাদীসের ভিতর থেকে বের করে উম্মতের জন্য উন্মোচিত করে দিয়েছেন।

মূলতো আমরা মানছি কুরআন ও সুন্নাহকে। কিন্তু না বুঝার কারণে সহায়তা নিচ্ছি মুজতাহিদ ইমামগণ থেকে। পরিস্কার বুঝা গেলো, মাযহাবের ইমামগণ মাসআলা বানাননি, বরং তারা কুরআন ও হাদীসের ভিতর থেকে মাসআলা দেখিয়েছেন।⏬


💐বিষয়টি সম্পর্কে আরো পরিস্কার ধারণা রাখতে হলে আমাদের তিনটি পরিভাষা সম্পর্কে জানতে হবে। 

শব্দগুলো হলোঃ 

১-মুজতাহিদ।

 ★২-মুকাল্লিদ। 

★৩-গায়রে মুকাল্লিদ।⏬


মুজতাহিদ কাকে বলে?


মুজতাহিদ ঐ ব্যক্তিকে বলে, যিনি কুরআন ও সুন্নাহ ঘেটে নিজে নিজে অজু গোসল, নামায, হজ্ব ইত্যাদিসহ মানুষের জীবন ঘনিষ্ট সকল মাসায়েল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহ, মুস্তাহাব, মাকরূহ, এসব ভেঙ্গে যাবার কারণ ইত্যাদি আলাদা আলাদা করে বের করে আমল করতে সক্ষম, উক্ত ব্যক্তিকে বলে মুজতাহিদ। অর্থাৎ যিনি নিজে নিজে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জীবন ঘনিষ্ট যাবতীয় মাসায়েল বের করে আমল করতে পারেন, তাকে বলা হয় মুজতাহিদ। যেমন চার মাযহাবের ইমামগণ ছিলেন মুজতাহিদ।⏬


মুকাল্লিদ কাকে বলে?


মুকাল্লিদ উক্ত ব্যক্তিকে বলে, যিনি নিজে নিজে কুরআন ও সুন্নাহ ঘেটে জীবন ঘনিষ্ট সকল মাসায়েল নির্দিষ্ট আকারে বের করতে পারে না, কিন্তু যিনি পারেন, সেই মুজতাহিদের বের করা মাসায়েল অনুপাতে আমল করে আল্লাহর বিধানের পাবন্দী করেন। উক্ত ব্যক্তিকে বলা হয় মুকাল্লিদ।

যেমন আমরা সবাই হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ।


গায়রে মুকাল্লিদ কারা?


✅যারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নিজো প্রাজ্ঞতায় জীবন ঘনিষ্ঠ সমস্ত মাসায়েল নির্দিষ্ট আকারে বের করতে পারেও না, আবার যারা পারেন, সেই মুজতাহিদের উদ্ভাবিত মাসায়েল অনুসরণও করেন না, বরং নিজে নিজে পন্ডিতী করেন, তাদের বলা হয়, গায়রে মুকাল্লিদ। তাদেরই আরেক নাম (কথিত) আহলে হক।⏬

কয়েকটি উপমার মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবেঃ


💐উপমা নং-১


✅সমুদ্রের তলদেশে হীরা মাণিক্য জহরত রয়েছে। যা সবারই প্রয়োজন। কিন্তু সবাই ডুবুরী নয়। ডুবুরী নিজো যোগ্যতায় ডুব দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে হীরা মাণিক্য জহরত আহরণ করে তা ব্যবহার করে। আর যারা ডুবুরী নয়, তারা উক্ত ডুবুরীর মাধ্যমে উক্ত হীরা মাণিক্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করে।

যারা ডুব দিতে জানে না, তারা ডুবুরীর মাধ্যমে হীরা মাণিক্য জহরত পেয়ে ডুবুরীর জন্য দুআ করে। কিন্তু শুকরিয়ায় মাথা নতো করে আল্লাহর দরবারে।⏬

❇আরেক দল ডুবুরী নয়। আবার ডুবুরীর কাছেও যায় না, বরং ডুব না জানা সত্বেও ডুব দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

তেমনি কুরআন ও হাদীসের অভ্যন্তরে মাসায়েলের হীরা মাণিক্য জহরত লুকায়িত। মুজতাহিদ স্বীয় যোগ্যতা বলে সে মাসআলা বের করে আমল করে। আর মুকাল্লিদরা মুজতাহিদের আহরিত মাসায়েলের হীরা মাণিক্য দ্বারা আমল করে।

মুকাল্লিদগণ মুজতাহিদের আহরিত মাসায়েল অনুপাতে আমল করে ইবাদত করে আল্লাহর। আর মাসায়েল সংগ্রাহক মুজতাহিদের জন্য দুআ করে। আর গায়রে মুকাল্লিদরা মুজতাহিদের কাছে না গিয়ে মাসায়েল বের করার যোগ্যতা না থাকা সত্বেও গবেষণার নামে দ্বীনের মাঝে ফিতনার সৃষ্টি করে।⏬


💐উপমা নং-২


✅কোনো এলাকায় নতুন নির্মিত মসজিদের সকল মুসল্লির জন্যই অযু করতে পানি প্রয়োজন। কিন্তু সবার পক্ষে জমিন খনন করে পানি বের করে অযু করা সম্ভব নয়।

তখন জমিন খনন করতে সক্ষম কোনো দানবীর ব্যক্তি এসে তার মুজাহাদা মেহনত ও শ্রম দিয়ে জমিনের নিচ থেকে মুসল্লিদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে কুপ ইত্যাদি খনন করে দেয়।⏬

❇খননকৃত কুপের পানি আল্লাহর সৃষ্টি করা। সেই পানি কেবল দানবীর ব্যক্তিটি স্বীয় মুজাহাদা দিয়ে প্রকাশ করে দিয়ে মুসল্লিদের উপর ইহসান করে থাকে। অনেক সময় পানি প্রকাশক উক্ত ব্যক্তির নামে কুপের নামকরণও হয়ে যায়। নামকরণ ব্যক্তির নামে হলেও সবাই জানেন উক্ত পানি জমিনের নিচে জমিনের সৃষ্টি লগ্ন থেকেই ছিলো এবং পানির ¯স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। দানবীর ব্যক্তি কেবল পানির প্রকাশক।

তখন উক্ত মসজিদের মুসল্লিরা কূপের পানি দ্বারা অযু করে মসজিদে প্রবেশ করে ইবাদত করে আল্লাহর। কিন্তু যেহেতু দানবীর ব্যক্তিটি জমিনের নিচ থেকে পানি প্রকাশ করে দিয়ে মুসল্লিদের উপর ইহসান করেছে, তাই মুসল্লিগণ উক্ত পানি দিয়ে অযু করে দানবীর ব্যক্তির জন্য দুআ করে।⏬

❇তেমনি কুরআন সুন্নাহের গভীরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অযু, গোসল, সালাত ইত্যাদিরর ফরজ, সুন্নত মুস্তাহাব ইত্যাদি কুরআন ও হাদীসের সূচনালগ্ন থেকেই তাতে প্রবিষ্ট করিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সবার পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সেসব মাসায়েল নিজে নিজে বের করে আমল সম্ভব নয়। কিন্তু সবারই অযু করা প্রয়োজন। সবাই নামায পড়া প্রয়োজন। তখন মুজতাহিদ ইমামগণ তাদের মুজাহাদা মেহনত দিয়ে কুরআন ও হাদীসের ভিতর থেকে মাসায়েলগুলো বের করে, আলাদা আলাদা শিরোনাম দিয়ে দিয়ে, নির্দিষ্ট আকারে লিপিবদ্ধ করে উম্মতের জন্য প্রকাশ করে দিয়েছেন।

তখন মুজতাহিদের অনুসারীরা সেসব মাসায়েল অনুপাতে দ্বীন পালন করে, আর মাসায়েল বের করে দিয়ে ইহসানকারী মুজতাহিদ ইমামদের জন্য দুআ করে। কিন্তু ইবাদত করে আল্লাহর।⏬


💐উপমা নং-৩


✅নামাযের ইমামগণ ইমাম হবার কারণে তারা সরাসরি আল্লাহর ইবাদত করে, আর মুসল্লিরা ইমামের অনুসরণে ইবাদত আল্লাহরই করে। কিন্তু বাহ্যিকভাবে অনুসরণ করে ইমামের। তেমনি মুজতাহিদগণ ইমাম হবার কারণে তারা সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে মাসায়েল বের করে আমল করেন, আর মুকাল্লিদগণ মুজতাহিদ ইমামদের অনুসরণে ইবাদত করে আল্লাহর। কিন্তু বাহ্যিকভাবে অনুসরণ করে মুজতাহিদ ইমামের।⏬


💐উপমা নং-৪


✅ভারতের সংবিধানের কোনো আইনী জটিলতায় কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে, উক্ত ব্যক্তি সংবিধান বিশেষজ্ঞ উকীলের কাছে গমণ করে। আর উক্ত উকীলের পথনির্দেশনায় মুআক্কিল ব্যক্তি ভারতের সংবিধান মান্য করে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি উকীলের নির্দেশনা মানার কারণে মুআক্কিলকে সংবিধান বিরোধী আখ্যায়িত করে না। করাটা আহমকী ছাড়া আর কী’বা হতে পারে?⏬

❇তেমনি কুরআন ও সুন্নাহ হলো আল্লাহর দেওয়া সংবিধান। যারা এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ নয়, তারা উক্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মুজতাহিদ ইমামদের পথনির্দেশনায় আল্লাহর সংবিধান মান্য করে থাকে। আশা করি মাযহাবের অনুসরণের হাকীকত পরিস্কার হয়ে গেছে। মাযহাব মানা মানে কুরআন ও হাদীসের ভিন্ন কিছু মানা নয়। বরং কুরআন ও হাদীস বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির পথনির্দেশনায় কুরআন ও হাদীস মানার নাম হলো মাযহাব অনুসরণ। আর কুরআন ও হাদীস না বুঝার পরও নিজের উদ্ভট বুঝ অনুপাতে দ্বীন মানার নামই হল গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাত।🔚

Post a Comment

0 Comments